বাংলা নববর্ষের ইতিহাস জেনে নিন বিস্তারিত
বাংলা নববর্ষের ইতিহাস - আসসালামু আলাইকুম প্রিয় পাঠকবৃন্দ, কেমন আছেন সবাই। আশা করি সবাই ভালো আছেন। আজকে আপনাদের সাথে শেয়ার করব বাংলা নববর্ষের ইতিহাস নিয়ে। আশাকরি, সবাই মনোযোগ সহকারে পড়বেন। তো চলুন শুরু করা যাক।
বাংলা পঞ্জিকার প্রবর্তক ও মাসের নামকরণ
বাংলা নববর্ষ আমাদের সংস্কৃতিতে কিভাবে এলো তা জানতে হলে আমাদের অবশ্যই বাংলা নববর্ষের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে। পহেলা বৈশাখ বা পয়লা বৈশাখ পালন করা হয় বাংলা বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিনে। এই বাংলা বছর বা বাংলা পঞ্জিকা কিভাবে এলো? প্রথমে সৌর পঞ্জি অনুসারে বাংলা মাস পালিত হতো অনেক প্রাচীনকাল থেকেই। তখনও আসাম, তামিল নাড়ু, ত্রিপুরা, বঙ্গ, পাঞ্জাব প্রভৃতি সংস্কৃতিতে বছরের প্রথম দিন উদযাপনের রীতি ছিলো।
তাহলে বাংলা নববর্ষের ইতিহাসে বাংলা বারো মাস কিভাবে এলো? আর এর দিন, ক্ষণ কিভাবে ঠিক করা হলো? বাংলা সনের প্রবর্তক নিয়ে সম্রাট আকবর বেশি আলোচিত হলেও, বাংলা পঞ্জির উদ্ভাবক ধরা হয় আসলে ৭ম শতকের রাজা শশাঙ্ককে । পরবর্তীতে সম্রাট আকবর সেটিকে পরিবর্তিত করেন খাজনা ও রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে। প্রথমে আকবরের পঞ্জিকার নাম ছিল “তারিখ-এ-এলাহী” আর ঐ পঞ্জিকায় মাসগুলো আর্বাদিন, কার্দিন, বিসুয়া, তীর এমন নামে। তবে ঠিক কখন যে এই নাম পরিবর্তন হয়ে বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য, আষাঢ়, শ্রাবণ হলো তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না।
আরও পড়ুনঃ ওরাকল মানসিক দক্ষতা বই পিডিএফ
ধারণা করা হয় যে, বাংলা বারো মাসের নামকরণ করা হয়েছে বিভিন্ন নক্ষত্র থেকে। যেমন- বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, জায়ীস্থা থেকে জৈষ্ঠ্য, শার থেকে আষাঢ়, শ্রাবণী থেকে শ্রাবণ এমন করেই বাংলায় নক্ষত্রের নামে মাসের নামকরণ হয়।
সম্রাট আকবর রাজস্ব আদায়ের জন্য কেনই বা নতুন পঞ্জিকা নির্ধারণ করলে?
ভারতবর্ষে মোগল সম্রাজ্য পরিচালিত হতো, হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে। আর হিজরি পঞ্জিকা চাঁদের উপর নির্ভরশীল। যেহেতু কৃষকদের কৃষি কাজ চাঁদের হিসাবের সাথে মিলতো না, তাই তাদের অসময়ে খাজনা দেয়ার সমস্যায় পরতে হতো। সেই কারণে খাজনা আদায়ে কৃষকদের যেন কোনো অসুবিধা না হয়, সম্রাট আকবর বর্ষ পঞ্জিতে সংস্কার আনেন। তখনকার বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সম্রাট আকবরের আদেশে সৌর সন ও হিজরি সন এর উপর ভিত্তি করে বাংলা সনের নিয়ম তৈরি করেন।
১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে প্রথম বাংলা সন গণনা করা হয়। তবে আনুষ্ঠানিকভাবেই খাজনা আদায়ে এই গণনা কার্যকর শুরু হয়েছিল ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর থেকে। পূর্বে ফসল কাঁটা ও খাজনা আদায়ের জন্য এই বছরের নাম দেয়া হয়ে ছিলো ফসলি সন । পরে তা বঙ্গাব্দ আর বাংলা সন করা হয়। তখন চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে খাজনা, শুল্ক দিতে হতো কৃষকদের। তাই তখন থেকেই সম্রাট আকবর কৃষকদের জন্য মিষ্টি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। হালখাতার প্রচলনও সম্রাট আকবরের সময় থেকেই ব্যবসায়ীরা করেছে।
বর্তমানের বাংলা পঞ্জিকা ও বাংলা নববর্ষ পালন
বর্তমানের বাংলা সন এসেছে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে। বাংলাদেশে এই গ্রেগরীয় বর্ষ পঞ্জি অনুসারে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল শুভ নববর্ষ পালন করা হয়। ১৯৮৯ সাল থেকেই মঙ্গল-শোভাযাত্রা বাঙ্গালির নববর্ষ উদযাপনের একটি প্রধান আকর্ষন। উল্লেখ্য যে, ২০১৬ সালে ইউনেস্কো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর চারুকলা অনুষদ থেকে আয়োজিত যে মঙ্গল-শোভাযাত্রার বের করে, সেটিকে “মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য” হিসেবে ঘোষাণা করে।
বাংলাদেশে নববর্ষ ১৪ এপ্রিল পালিত হলেও পশ্চিম বঙ্গে তা ১৫ এপ্রিল পালন করা হয়। কারণ, ভারতে হিন্দু সম্প্রদায় তিথি পঞ্জিকা অনুসরণ করে থাকে। বাংলাদেশে আধুনিক বাংলা বর্ষ পঞ্জিকায় গ্রেগরীয় পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা একাডেমি কর্তৃক ১৪ এপ্রিল বাংলা বছরের প্রথম দিন নির্দিষ্ট করা হয়।
আরও পড়ুনঃ জয়কলি রাবি প্রশ্ন ব্যাংক পিডিএফ
বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় নিয়ে বিবাদ
বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় নিয়ে দু’টি গোত্র লক্ষ্য করা যায়। কেউ বলে ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে বাংলা বছরের শুরু হয়, তাই শুভেচ্ছা তখনই দিতে হবে। আর অপর পক্ষ বলে ইংরেজি পঞ্জিকার ন্যায় রাত ১২টার পরেই পহেলা বৈশাখের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে হয়। আসলে কোনটি সঠিক? ভোরের আলো ফুটার আগে কি আমাদের দেশে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানানো যাবে না? যেহেতু আধুনিক বাংলা পঞ্জিকা গ্রেগরীয় পঞ্জিকা অনুসরণ করে, তাই সে নিয়ম অনুযায়ী রাত ১২টার পরেই আমাদের নতুন বছর শুরু হয়ে যায়। তাই, আমাদের দেশে আমরা রাত ১২টার পরেই বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে পারি।
বাংলা নববর্ষের ইতিহাস থেকে বর্ষ বরণের রীতি-নীতি
সম্রাট আকবরের শাসনামল থেকে পহেলা বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলেও পরবর্তিতে বিভিন্ন বাঙ্গালি রীতি-নীতি আমাদের বর্ষ বরণে স্থান পেয়েছে। সেগুলোর কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো-
গ্রামীন রীতি-নীতি
গ্রামীন রীতি অনুসারে ভোর সকালে কৃষকেরা নতুন জামা গায়ে দিয়ে পরিবারের সাথে নানান পদের ভর্তা দিয়ে পান্তা ভাত, পিঠা-পুলি, মিষ্টি খেয়ে দিনটি সূচনা করে। তাছাড়া, কয়েকটি গ্রাম মিলে বৈশাখী মেলার আয়োজন করতো। সেখানে বিভিন্ন ব্যবসায়ীরাও তাদের পণ্য মেলায় উঠাতেন। কেউ মাছ, কেউ খেলনা, কেউবা শাড়ি-চুড়ি, চুলের ফিতা। ধারণা করা হয় আমাদের ইলিশ মাছ খাবার ঐতিহ্য এই মেলা থেকেই এসেছে।
রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ ও মঙ্গল-শোভাযাত্রা
প্রতি বছর রমনার বটমূলে ছায়ানটের গানের অনুষ্ঠান থাকে। সূর্য উঠার সাথে সাথে নতুন বছরের মঙ্গল কামনায় রমনার বটমূল গানে গানে মুখরিত হয়ে উঠে। সকলে মিলে একই সুরে গেয়ে ওঠে-“এসো, হে বৈশাখ এসো এসো”। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে গ্রামীন সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন মুখোশ ও মুর্তি বানিয়ে ঢাকার রাস্তায় শোভাযাত্রা করে বরণ করা হয় নতুন বছরকে। এই শোভাযাত্রায় অংশ নিতে পারে সকলেই।
প্রাচীন বউমেলা ও ঘোড়ামেলা
সোনারগাঁও এ ঈসা খাঁ এর আমলে বউমেলা হতো। সেখানে স্থানীয় বটতলায় কুমারী, নববধূ ও মায়েরা তাদের মনের ইচ্ছা পূরণে পূজা করতো। পাঁঠা বলি দেয়া হতো আগে। তবে এখন শান্তির বার্তার আশায় তারা দেবীর কাছে কবুতর বা পায়রা উড়িয়ে দেয়।
এছাড়াও সোনারগাঁও এ ঘোড়ামেলারও প্রচলন ছিলো। লোকমুখে প্রচলিত আছে যে, আগে যামিনী সাধন নামের এক ব্যক্তি নববর্ষের দিন ঘোড়া চড়ে সবাইকে প্রসাদ দিত। তার মৃত্যুর পরে সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হয় এবং পরবর্তীতে এটিকে কেন্দ্র করে মেলার আয়োজন হয়। আগে মাটির ঘোড়া রাখা হতো, এরপর থেকে মেলায় নাগর-দোলা, চরকা, ঘোড়ার আকারে ঘূর্ণী দোলনা রাখা হয়।
শেষ কথা
আজকের পোস্টে বাংলা নববর্ষের ইতিহাস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আশা করি সবাই বুঝতে পেরেছেন। কেউ কিছু বুঝতে না পারলে কমেন্ট বক্সে জানাবেন।
পোস্টটি ভালো লেগে থাকলে অবশ্যই বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন। ধন্যবাদ সবাইকে।